‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একেবারে উতলা হয়ে পড়েছে’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সব থেকে অবাক লাগে। যেসব দেশে এই খুনিদের (বঙ্গবন্ধুর) আশ্রয় দিয়ে রাখা হয়েছে, তারা আমাদের কাছে এসে মানবাধিকারের কথা বলে। তারা নির্বাচনের কথা বলে, স্বচ্ছতার কথা বলে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একেবারে উতলা হয়ে পড়েছে। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- ২০০১ সালের নির্বাচনে এদেশে নির্বিচারে অত্যাচার চললো। কত মানুষকে খুন করেছে। হাত কেটেছে। চোখ তুলে নিয়েছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে। তখন নির্বাচন নিয়ে কোন কথা হয়নি কেন? সেই নির্বাচনে তো আমাদের হারার কথা নয়। সে নির্বাচনে তো জোর করে আমাদের হারানো হয়েছে। খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহিন নির্বাচন করেছিল। তখন তাদের নির্বাচনী চেতনা কোথায় ছিল? জিয়াউর রহমান বা জেনারেল এরশাদের সময় ৪৮ ঘন্টা ভোটের ফল বন্ধ করে রেখে ফল ঘোষণা করে সেটা নিয়ে তো এদের কোন উদ্বেগ তো আমরা দেখিনি। আজকে তাদের কাছ থেকে নির্বাচনের কথা, মানবাধিকারের কথা আমাদের শুনতে হয়। তো আমাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল যেখানে আমরা বাবা মায়ের হত্যার বিচার চাইতে পারতাম না। হত্যার বিচার চেয়ে একটা মামলা করার অধিকার আমাদের ছিল না। ১৯৮৮ সালে এরশাদের নির্বাচনের সময় তো তাদের উদ্বেগ দেখিনি। হঠাৎ এবারের ইলেকশনের সময় যেন খুব বেশি উতলা হয়ে পড়লো।

বুধবার (১৬ আগস্ট) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকী ও জাতীয় শোকদিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘স্মরণ সভা’য় সভাপতিত্বকালে দেয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ‘স্মরণ সভা’র প্রারম্ভিক বক্তৃতা করেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং বর্ষিয়ান নেতা আমির হোসেন আমু, সভাপতি মন্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও এডভোকেট কামরুল ইসলাম সভায় বক্তৃতা করেন। আরো বক্তৃতা করেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এডভোকেট তারানা হালিম, মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি ও হুমায়ুন কবীর। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল আউয়াল শামীম সভা সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট শহীদ বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদ, জেল হত্যাকান্ডের শিকার জাতীয় চারনেতা, ভাষা আন্দোলন এবং ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার শহীদসহ সকল গণআন্দোলনের শহীদদের স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি সেই ’৭৫ সাল থেকে এই চক্রান্ত করছে, তারা চক্রান্ত করেছে আর দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলছে। এ দেশের মানুষ যখন নৌকায় ভোট দিয়েছে স্বাধীনতা পেয়েছে। আজকে তারা পেট ভরে খেতে পারছে, বিদ্যুৎ পাচ্ছে, রাস্তাঘাট পেয়েছে, কর্মসংস্থান পাচ্ছে, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে- বঙ্গবন্ধু যা চেয়েছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যার প্রসঙ্গ টেনে সেদিন তিনি তাঁর পরিবারকে হারালেও বাঙালি জাতি তাঁর সকল সম্ভবনাকে হারিয়ে ফেলে, বাবা-মা-ভাই সব হারিয়েছিলাম। কিন্তু একটাই প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছিলোম লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে ব্যর্থ হতে দেব না। ’৭৫-এর শোক-ব্যথাকে বুকে ধারণ করে দিনরাত কাজ করে গেলেও একের পর আঘাত, প্রাণসংহারের প্রচেষ্টা তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, আমারও সময় সীমিত, কত ভয়ানক মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। আমার নেতা-কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। আমার দলের নেতা-কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে রক্ষা করেছে। আমার বাবা রক্ত দিয়ে গেছেন এদেশের মানুষের জন্য। রক্ত দিয়ে গেছেন আমার মা-আমার ভাইয়েরা। প্রতি নিয়ত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে আমাদের দিনরাত প্রচেষ্টা এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন ভূমিহীন মানুষের জন্য ঘর করে দেওয়া। তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাই মুজিববর্ষে আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল দেশে একটি মানুষও আর ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে না। সরকার বিনে পয়সায় ২ কাঠা জমিসহ ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে, আজকে প্রায় ৮ লাখ ২৯ হাজার ৬৬০টি পরিবারকে বিনে পয়সায় জমিসহ ঘর দিয়ে তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর মাত্র সাড়ে ১১ হাজার বাকী আছে তাদেরও ঘর তৈরী হবে। এটা হয়ে গেলে পরে দেশের আর একটি মানুষও ভুমিহীন-গৃহহীন থাকবে না। প্রত্যেকেরই একটা ঘর বা ঠিকানা হবে। এভাবে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষের যে কাজ করছে সেটাই ‘অনেকের অন্তজ্বালা। লুটে খেতে পারছে না, ক্ষমতা নাই, জনগণকে শোষণ করতে পারছে না। জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারছে না, তাই নির্বাচনে কারচুপির ধূয়া তুলছে। বিএনপির মুখে নির্বাচনে কারচুপির কথা আসে কোত্থেকে। ভোট চুরির অপরাধে খালেদা জিয়া দুই-দুইবার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। তারপরেও তাদের মুখে আবার গণতন্ত্রের কথা। আসল কথা ওরাতো নির্বাচন চায় না। কারণ, তারা কাকে নিয়ে নির্বাচন করবে তাদের দুইনেতার একজন এতিমের অর্থ আত্মস্বাতের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, আরেকজনের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক এবং আর কোনদিন রাজনীতি করবে না বলে মুচলেখা দিয়ে দেশ থেকে চলে গিয়েছে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে তৎপর গুটিকতক দেশের কতিপয় রাজনীতিবিদ ও সংস্থার অতি উৎসাহের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদের উদ্দেশ্য গণতন্ত্র নয়, এরা একটা জিনিসই করতে চায়, সেটা বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। এটা করাই হচ্ছে কারো কারো উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু এদের নানা ধরনের তালবাহানা। এটা দেশবাসীকে বুঝতে হবে। আজকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভিত্তিটা আমরা মজবুত করেছি, জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছি বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ আজকে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের পথে আজকে দারিদ্রের হার আমরা ৪১ থেকে ১৮ ভাগে আমরা নামিয়ে এনেছি। হতদরিদ্র যেটা ২৫ ভাগ ছিল সেটাকে আমরা ৫ দশমিক ৭ ভাগে নামিয়ে এনেছি।

দেশের ভৌগলিক অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনায় নানা চক্রান্তের বিষয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বিষয়ে আমাদেরকে যেমন সজাগ থাকতে হবে, তাছাড়া অন্যান্য দেশ, আমি তো বলবো ভারত মহাসাগরের অন্যান্য দেশ, তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন আছে, সেটা আমি বিশ্বাস করি। ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে ভারত মহাসাগর, অপরদিকে প্রশান্ত মহাসাগর, এই ভারত মহাসাগরেই কিন্তু আমাদের বে অব বেঙ্গল, এর গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রাচীনকাল থেকে এই জায়গা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। ভারত মহাসাগরে যতগুলো দেশ আছে কারো সঙ্গে আমাদের কোন দ্বন্দ্ব নাই, সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক একটা যোগাযোগ পথ। এই জলপথে আন্তর্জাতিক ভাবে সবচেয়ে নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহন হয়। দেশবাসীকে বলবো, যারা দেশপ্রেমিক তাদের সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। কেননা, বাংলাদেশের মানুষের এতটুকু ক্ষতি করে কোনদিন ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করি না। পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে, এই এলাকাটা নিয়ে নানা ধরনের খেলার একটা চক্রান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০ বছর ধরে যেখানে সংঘাত ছিল আমি সরকারে আসার পর সেখানে আমি শান্তি ফিরিয়ে আনি। সেখানেও আবার নানা রকম অশান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা হচ্ছে।

দেশের তথাকথিত স্বার্থন্বেষী বিজ্ঞতার দাবিদার মহল সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কিছু আঁতেল আছে জানি না এসব তারা চিন্তা করে কি না। সেগুলো না করেই তারা এদের সঙ্গে সুর মেলায়। দুটো পয়সার লোভে তারা নানা ভাবে এই কাজগুলো করে বেড়ায়।

জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর হত্যায় জড়িত পুনরুল্লেখ করে ১৫ আগস্ট প্রতিহিংসামুলক ভূয়া জন্মদিন পালন করায় খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুনি মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলো, প্রথমেই জিয়াকে সেনাপ্রাধন বানালো। জিয়াউর রহমান এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মীর জাফর যেমন তিন মাসের বেশি থাকতে পারেনি, তেমনি মোশতাকও থাকতে পারেনি। জিয়া ক্ষমতা দখল করে। উর্দি পরে ক্ষমতারোহণ এবং পরে নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করারও চেষ্টা করে। আর্মি রুলস ভঙ্গ করে একটা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও করে। ভোট কারচুপি ও ভোটচুরির কালচার তো সেখান থেকে শুরু। জামাতের উত্থান জিয়াউর রহমানের হাতে। কারণ, এই জামায়াত ছিল যুদ্ধাপরাধী। তাদের কোন ভোটাধিকার ছিল না। তাদের দল করবার অধিকারও ছিল না। জিয়াউর রহমান মার্শাল-ল অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে সংবিধানের ১২ ধারা বিলুপ্ত করে এবং এদের ভোটের যে অধিকার ছিল না সেই ৩৮ ধারা বাদ দিয়ে ভোট করার অধিকার ফিরিয়ে দেয়। ভোট কারচুপির মধ্য দিয়ে যে সংসদ গঠন করে সেই সংসদে এই আইন পাস করে। স্বাধীনতা বিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানায়। দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী জয়পুরহাটের আব্দুল আলিমসহ আরো যারা রাজাকার ছিল তাদেরকে মন্ত্রী উপদেষ্টা বানিয়ে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তুলে দেয় যুদ্ধাপরাধীদের হাতে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিভিন্ন দুতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা, ইনডেমনিটি অর্ডন্যান্স জারি করে খুনীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করার মত কলঙ্কজনক ঘটনার জন্মদাতা এই জিয়াউর রহমান। পরে এরশাদ এবং খালেদা জিয়া তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। সংবিধানের ৫ম সংশোধনী ও ৭ম সংশোধনী বাতিল করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথকে রুদ্ধ করা এবং সামরিক সরকারগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া উচ্চ আদালতের রায়কে সাধুবাদ জানান। আগামীর বাংলাদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন স্মার্ট বাংলাদেশ। যে পথে তাঁর সরকার অনেক দূর এগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলবোই। কোন খেলা খেলে বাংলাদেশের ভাগ্য কেউ যেন নষ্ট করতে না পারে সেজন্য দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে।